সৈয়দের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি : করি গান এ বুনো জোছনায়

শ্রদ্ধাস্পদ সম্পাদক
উত্তরাধিকার
বাংলা একাডেমী,ঢাকা।
সালাম ও শুভেচ্ছা। উত্তরাধিকার ভাদ্র ১৪১৭ সংখ্যাটি পেয়ে আনন্দিত হলাম। সব্যসাচী লেখক
আবদুল মান্নান সৈয়দ কে নিয়ে একগুচ্ছ লেখার আয়োজন এ আনন্দের উৎস।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার জানা সেই কৈশোর থেকে। আশি দশকের প্রারম্ভেই।
তাঁর ‘কবিতা কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড’ আমাকে প্রথম প্রাণিত করে। মেই তার লেখা
জোখার মুগ্ধ পাঠক হয়ে যাওয়া। মনে হয় মুগ্ধতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল তার এমন কোন
লেখা প্রকাশিত নেই, যা আমার পড়া হয়নি।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভেতরে যে সমালোচনাবোধ সেটি মান্নান সৈয়দেরই নির্মাণ করে
দেওয়া। তার ‘বিবেচনা পুনর্বিবেচনা’ (জুন ১৯৯৪) এর প্রবন্ধগুলো পত্রিকায় লিটলম্যাগে
প্রকাশের সাথে আমাকে যেন শিতি করে তুলছিল, ‘শুদ্ধতম কবি’ ‘করতলে মহাদেশ’ তো
অনেক আগেই পড়া। তরুণ লেখক প্রকল্পে আমি প্রথম কাজ করতে চেয়েছিলাম একক গ্রন্থ
‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিয়ে। প্রশাসনিক অনুমতি না পাওয়াতে আর এগুয়নি। কবি আবদুল মান্নান
সৈয়দ তখন বর্ধমান হাউজের দ্বিতলায় ‘নজরুল রচনাবলী’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তারও
আগে ৮৬’ দিকে কবির সাথে আমার পরিচয়। বড় ভাই শিল্পী মোমিন উদ্দিন খালেদ কবি আবদুল
মান্নান সৈয়দের বেশ ক’টি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন সেই সূত্রে শিল্পতরু কার্যালয়ে। দীর্ঘ
আড্ডা ,অনেক অভিভাষণ – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তার শোনা হয়েছে। মুদ্ধতা উবে গিয়ে যখন তার
প্রকৃত পাঠক হয়ে উঠলাম তখন মনে হলো তার কবিতার প্রলম্বিত ভাষ্য তার নভেলাগুলো।
আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ তিনটি স্মৃতির নোটবুক (২০০১)
শিল্পতরু প্রকাশনী। ‘ডায়েরি ১৯৭৮-২০০৮’ (পাঠকসমাবেশ ২০০৯) ও ভেসেছিলাম ভাসা
ভেলায় (সুচীপত্র ২০০৯)। এ ত্রি-আত্মজৈবনিক রচনার সাথে যদি নভেলাগুলোকে মিলিয়ে পড়ে
উপন্যাসের সৈয়দের সাথে কবি সৈয়দ ও ব্যক্তি সৈয়দের এক সমান্তরাল রেখা নির্মাণ করতে
পারবেন।
মূলত : ধান ভানতে শিবের গীত যে জন্যেÑ উত্তরাধিকারের এ সংখ্যাটি পড়ে কয়েকছত্র অনুভূতি
জানাতেই এ পত্রবিন্যাস। প্রথমেই ভীমরী খেলাম আরেক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের
লেখাটিতে। সূচিপত্রে কোন বিন্যাসে লেখাটি না থাকতে আগপিছ দেখে মনে করেছিলাম প্রবন্ধ
কিংবা নিবন্ধ। কিন্তু না তা প্রবন্ধ ও নয় নিবন্ধও নয়। তাহলে কী? আরেক সৃজনশীলতা
অনুভূতিগুচ্ছ কিন্তু এটাকে কবিতা বললে কী হতো? তাহলে এটা কি সাহিত্যের আদলে
পৌরিহত্য? বেশ দ্বন্দ্ব ঠেকেছে। পাঠক বিচারে এটি আমার কবিতাই মনে হয়েছে। তবে
সম্পাদনা পর্যদ সৈয়দের সৈয়দত্ব ঠিক রাখলেও তা প্রচ্ছনড়বভাবে আচ্ছনড়ব করে রাখলো আমার
চেতন সত্ত্বাকে।
সম্ভ্রমের সাথে বাংলা সাহিত্যে সৈয়দরা সৈয়দ হয়ে আছেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য। সৈয়দ
সুলতান মধযুগের অসাধারণ কবি প্রতিভা। সৈয়দ আলী আহসান ও সৈয়দ আলী আশরাফ
অসাধারণ কৃতি পুরুষ বাংলাসাহিত্য ও বাংলায় মুসলিম শিাদর্শনে। সৈয়দ আবদুল মাকসুদ
বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের অনন্য দিকপাল। সৈয়দ আকরাম হোসেন রবীন্দ্র গবেষণাসহ কথা
সাহিত্যে তুলাহীন বিশ্লেষক।
সৈয়দ শামসুলহক কবি, ঔপন্যাসিক, গাল্পিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক
কোন পরিচয়ে তাকে আবিধিত করবো। এর পর আবদুল মান্নান সৈয়দ। যদিও তার সৈয়দটা
পরে। পরে কেন তা নিয়ে শিল্পতরু’র এক সংখ্যায় পঞ্চাশের এক কবি তালিম হোসেনের এক
পত্র পাঠ করে ছিলাম। যদিও এখন আমি পত্রপাঠ করছি না। আরও অনেক কথা বুদ করছে
আমার অনুভূতিতে। আবদুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদিত লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকায় যে
সম্পাদকীয় গুলো লিখেছিলেন তা তিনি গ্রন্থিত করে প্রকাশ করেছেন। এতো সু ও স্ব সম্পাদিত
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের পর আর ক’জন এসেছেন বাংলা সাহিত্যে? সম্পাদকের কলমের (সূচিপত্র
২০০৫) সাথে প্রকাশিত এ গ্রন্থে শেষে তিনি তালিম হোসেনের চিঠিটি পুনর্মদ্রণ করেছেন! তিনি
লিখেছেন:
প্রিয় আবদুল মান্নান সৈয়দ নামের শব্দ ত্রয়ের যে কোন একটা দিয়েই তোমাকে সম্বোধন করতে
পারতাম। কিন্তু খালি আবদুল, মানে হয় না, এ বাড়ি ওবাড়ি অনেক আছে। মান্নান ও থৈবচ,
আর শুধু সৈয়দ? খামাখা আশরাফ আতরাফ কমপেকস উস্কে দেয়! তাছাড়া আগের সৈয়দ পরে কেন?
তুমি মডার্ন মানুষ, তাই সৈয়দের আভিজাত্যকে অত মূল্য না দেবার জন্যে আকিকার নাম
ওলটপালট করেছো তাও মনে হয় না একজন লেখক সাংবাদিক ছিলেন সৈয়দ আবদুল
মানড়বান। তার সাথে নামের ক্যাশ হয় এটা একটা কারণ হতে পারো বটে। বাংলা লেখক কুলে
বেশ ক’জন বিশিষ্ট সৈয়দের মধ্যে আধুনিক কালের দু’জন সৈয়দ মুজতবা আলী ও সৈয়দ আলী
আহসান এখনো জ্বলজ্বল করছেন, এবং সৈয়দ এর নিশানা উড়িয়েই। তোমার তো ংযধশু
হওয়ার কারণ দেখি না। তাহলে কি সিদ্ধান্ত? নামের সুস্থির সনাতন শব্দমালা এলোমেলো করে
দিয়ে সেখানেও লেখায় ভাবনায় এবং কর্মকান্ডে তুমি যে স্বতন্ত্র, আর-দশজনের মতো
গতানুগতিক নও, তার ঘোষণা উড্ডীণ করেছ। ….
(সূত্র : শিল্পতরু, প্রথমবর্ষ! দ্বিতীয় সংখ্যা, বৈশাখ ১৯৯৫)
এই পত্রেই চিহ্নিত হয়ে যায় আসলে আবদুল মান্নান সৈয়দের চারিত্র। ‘চারিত্র’ নামে যে পত্রিকা
তিনি সম্পাদনা করতেন, এছাড়া ‘জীবননান্দ’,‘এখন’,‘শিল্পতরু’,‘শিল্পকলা’,‘কিছুধ্বনি’,
‘নজরুল একাডেমী পত্রিকা’ সবই আলাদা স্বাতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহণ করে বলে দিত এটি আলাদা
সুমার্জিত সুসম্পাদিত সৃজনশীল এক বহুমাত্রিক পত্রিকা। বলে দেয় এগুলো আবদুল মান্নান
সৈয়দ সম্পাদিত পত্রিকা।
কিন্তু তাকে নিয়ে যে সংখ্যাটি করা হলো তা এতো অপূর্ণ হবে ভাবিনি। খোন্দকার আশরাফ
হোসেন নিঃসঙ্গ ঘোড়সওয়ার নামে প্রথম প্রবন্ধটি তার পূর্বের প্রবন্ধ (কুয়াশর হ্রেষা: আবদুল
মান্নান সৈয়দের কবিতা) একবিংশ ডিসেম্বর ১৯৯০ সংখ্যা (পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশের কবিতা’
‘অন্তরঙ্গ অবলোকন’, বাংলা একাডেমী থেকে গ্রন্থিত) এর মতই অসম্পূর্ণ কবিতা আলোচনা।

আবদুল মান্নান সৈয়দ এর কাব্যসমগ্র বেরিয়েছে ২০০২ সালে শিল্পতরু থেকে এরপর কবিতার
বই (অ্যাডর্ণ ২০০৬), ‘হে বন্ধু বন্ধু হে প্রিয়তম’ (পাঠক সমাবেশ ২০০৬) ‘আঘ্রাণের নীল দীন’
(সূচীপত্র ২০০৭) ‘জনসাধারণ অসাধারণ’ (অমিত্রার ২০০৮) ‘মাতাল কবিতা পাগল পদ্য’
(পাঠক সমাবেশ ২০০৮) ছাড়াও অগ্রন্থিত কিন্তু প্রকাশিত কবিতা রয়েছে। এ ১৮ টি কাব্যগ্রন্থের
উপর একটি রেখাচিত্র নির্মাণ খন্দকার আশরাফ করতে পারতেন। তা আমরা পায়নি এবং পাইনি
প্রথম প্রবন্ধে খন্দকার আশরাফ যেমনিভাবে এড়িয়ে গেছেন ‘আবদুল মানড়বান সৈয়দের’ ‘কবিতা
কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ ‘গ্রন্থটির উপর আলোচনায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রথম প্রবন্ধের
উপর একটি প্রতিμিয়া জানিয়ে ছিলেন। ‘দরোজার পর দরোজা’ প্রবন্ধ গ্রন্থে এটি গ্রন্থিত
হয়েছে। এ প্রবন্ধে আশরাফের দৃষ্টি শুধু প্রথম প্রবন্ধের মত ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’, ‘জ্যোস্না রৌদ্রে
চিকিৎসা’, ‘পার্কস্ট্রিটের একরাত্রি’ ‘ও সংবেদনশীল ও জলতরঙ্গ’ ‘পরাবাস্তব কবিতা’ কবিতায়
নিবদ্ধ। সৈয়দের কবিতার যে বহুমাত্রিকতা তার প্রবন্ধে আমরা তা পায়নি। তার নীলিমাচারী
অন্তর্জালাবিহারী সত্ত্বার উন্মোচনের সত্যিই অপোয় ছিলাম। এখনও আছি। সৈয়দ যে কত
গভীরতম তা তার কবিতা পাঠক মাত্রেই জ্ঞাত।
চল, এইফাঁকে খেয়েনি: নিঃশান্তনু কায়সার ওরফে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক এর নিবন্ধটি কৌণিক
তবে আলো ফেলা। আমাদের সাহিত্যিক ও রাজনীতির এক দ্বন্দ্ব মুখ তুলে ধরেছেন কুটাচারি
শিতি সমাজের কাছে। কোথায় যেন এক প্রান্তিকতা।
নিমগ্ন সৈয়দ: আহমদ মাযহারের প্রবন্ধ। তত্ত্ব নয় এটি মূলত সৈয়দের বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ
তালিকা। প্রথমে প্রবন্ধ ও স্মৃতির কথা’র গ্রন্থগুলো এরপর কবিতাবলী, গল্প এবং উপন্যাসের
তালিকা। মাঝে মাঝে কদাচিৎ মন্তব্য।
আহমদ মাযহার প্রবন্ধের আলোচনায় ‘দিব্যি ভুলে গেলেন সৈয়দের ‘দরোজার পর দরোজা’
গ্রন্থটি উল্লেখ করতে। এছাড়া তার বিভিন্ন গ্রন্থের মাঝে প্রবন্ধের আদান-প্রদান যে রয়েছে তাও
বললেন না। বিশেষ করে নজরুল সংμান্ত গ্রন্থের মাঝে তার বার বার পুনর্বিন্যাসে রয়েছে। এবং
‘নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায়’ও তার প্রবন্ধের তালিকায় আসেনি। আসেনি তার ‘ছন্দ’ নিয়ে
একমাত্র গ্রন্থ ‘ছন্দ’ (প্রথমে বাংলা একাডেমী পরে অবসর থেকে প্রকাশিত) সৃষ্টি। এবং আসেনি
‘চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতানড়ে’ (শিল্পতরু ১৯৮৯) গ্রন্থটিও।
এ গ্রন্থগুলোর এক একটির চারিত্র তিনি তুলে না ধরে ভাসাভাসা মন্তব্য করে গেছেন শুধু। যা
তার এ নিবন্ধকে কিছুটা ুন্ন করেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আসলে কি আহমদ মাযহার
এসব প্রবন্ধ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন?
কারণ প্রবন্ধে মান্নান সৈয়দ অসাধারণ বিশদ পরিসরে কিছু কাজ করে গেছেন।
এক. জীবনানন্দ নিয়ে তুমুল বিশদ এবং আনুপুঙ্খ কাজ তার মত কেউ করেনি।
দুই. কাজী নজরুল ইসলাম নিয়ে তার মৌলিক তিনটি গ্রন্থ ও সম্পাদিত স্মারকগুলোর মধ্যে
দিয়ে নজরুল ইসলামের কবি ও সাহিত্যকর্মের এমন এক সম্পাদনাপর্ব তুলে এনেছেন যা
আগামীর সব সম্পাদকদের জন্য দূরসাধ্য ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তিনি তুলে ধরেছেন।
তিন. ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ঈশ্বরগুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী’, ‘দুই কবি’, এ তিন গ্রন্থের মাধ্যমে আধুনিক
বাংলা কবিতার ইতিহাসকে উন্মোচন করেছেন তুলনামূলক ঐতিহাসিক সমালোচনার ধারায় যা
বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ধারায় একান্ত বিরল।
চার. বেগম রোকেয়া, সৈয়দ ওয়ালিউলাহ,ফররুখ আহমদ সহ বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যিক
ধারা ও স্বাতন্ত্রকে তিনি ছেঁকে ছেঁকে তুলে এনেছেন। যা ছিল লুপ্ত প্রায়।
পাঁচ. ‘করতলে মহাদেশ’ও ‘বিশশতকের শিল্প আন্দোলন’ গ্রন্থের মাধ্যমে য়ুরোপবাহিত শিল্প
আন্দোলনগুলোর চারিত্র উন্মোচন করেছেন বাঙালি পাঠকদের কাছে বিশদভাবে।
ছয়. বাঙালির রুচিতে এনেছেন তিনি আতœজৈবনিক ভিন্নতা তার ‘আমার বিশ্বাস’ (১৯৪৪)
‘স্মৃতির’ ‘নোটবুক’ (২০০০) ‘ডায়রী’ ১৯৭৮-২০০৮ প্রকাশ : ২০০৯) ‘ভেসেছিলাম
ভাঙাবেলায়’ (২০০৯) এর মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনের কেদময় দিকটিও তুলে এসেছেন। যা খুউব
কম বাঙালি লেখক স্বীকার করেন।
এখানে উলেখ্য এ প্রবন্ধে ‘স্মৃতির নোটবুক’ গ্রন্থের প্রকাশ কাল উলেখ আছে ২০০০ সাল, প্রকৃত
হচ্ছে ২০০৯, ডায়েরী (১৯৭৮-২০০৮) গ্রন্থের মূল নাম ‘ডায়েরী ১৯৭৮-২০০৮’, প্রকাশ কাল
মূলত : ২০০৯। এসব অসাবধানতার কারণে তথ্য বিভ্রাট ঘটবে আগামীর গবেষকদের।
‘আমার বিশ্বাস’ তাঁর অসামান্য ব্যক্তিগত প্রবেন্ধর বই’র জন্য একটি বাক্যই কি এ গ্রন্থের জন্য
যথেষ্ট? মনে হয় খুউব অবিচারই করেছেন লেখক আহমদ মাযহার। ‘আমার বিশ্বাস’ (১৯৮৮)
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের এমন একটি গ্রন্থ যা বাংলা গদ্য সাহিত্যে এনে
দিয়েছিলো ভিন্নমাত্রা। এর আগে এমন করে নিজের গদ্যের, কবিতার, বিশ্বাসের কথা আর ক’জন
করেছেন, কেউ বলেননি এমন করে। গদ্য শৈলীতে যেমন অনন্য তেমনি বিষয়গভাবে নবতর।
ড. হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ সৈয়দেরই অনুবর্তী বললে ভুল হবে’; হবেনা। এছাড়া
আত্মজীবনী রচনায় আমরা ল করেছি বাঙালি লেখকরা এতো সৎ যেন বিবেকের প্রতিনিধি
হিসেবে প্রতি মুহুর্তে সμেটিস! কিন্তু জীবনের ভুলগুলো, পাপগুলো, রণহলো, দূর্বলতাগুলো,
কামগুলো, রিরিংসাগুলো আর ক’জনই বলতে পেরেছেন। কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন
নির্দ্বিধায় অকপটে এবং আগামী প্রজন্মের কাছে নিজেকে তুল ধরছেন আলো অন্ধকারে সবটুকুতে।
এবং বিশেষ দ্রষ্টব্যে লিখেছেন: আমার উত্তরাধীকারীদের প্রতি নির্দেশ। এই ডায়েরি যেভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে তার বাইরে অন্যকোনোভাবে যেন আমার ডায়েরি প্রকাশিত না হয়
আবদুল মানড়বান সৈয়দ
(ডায়েরি। ১৯৭৮-২০০৮ ভূমিকা শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা : ১৬)
নিমগ্ন সৈয়দ: প্রবন্ধে আহমদ মাযহার, সৈয়দের ‘পরাবাস্তব কবিতা’, যা ১৯৮২ তে প্রকাশিত
তার উল্লেখ্যই করলেন না। এবং বেমালুম ভুলে গেলেন তার গ্রন্থিত হয়ে আলাদাভাবে বের না
হওয়া কিন্তু তার কাব্যসমগ্রে (২০০২) আলাদা কাব্যগ্রন্থের মর্যাদা পাওয়া ‘মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়’
‘চতুর্দশপদী’, ‘শার্শিকাচ’ নিয়ে কোনো মন্তব্যই নেই, নেই তার উলেখ।
অথচ কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম কৈশোরের নায়িকা। ‘মীরা বন্দোপাধ্যায়’ কে নিয়ে কতনা স্থান দিলেন
তার স্মৃতিকথায়, উপন্যাসে, কবিতায়।
শ্রদ্ধাসম্পদ! কথায় কথায় অনেক প্রসঙ্গ চলে এলো!
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ বের করেছিল ২০০৭ সালে। ভূমিকায়
আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প: অর্ন্তলোকে সাফল্য বিহার শিরোনামে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ
ছিলো সমালোচক আহমদ মোস্তফা কামালের। এমন আন্ত-জরিপ দেখিনি আর আবদুল মান্নান
সৈয়দের গল্প নিয়ে। আসলেই সৈয়দে গল্পের যে আলাদা একটা ভূগোল আছে তা আরও স্পষ্ট
হওয়া দরকার আমাদের সমালোচনা সাহিত্যে। আহমদ মাযহারও কিয়ৎ পরিসরে তার গল্পের
উপর আলো ফেলেছেন।
জিনান সৈয়দ ও আহমদ মাযহার এর লেখায় উল্লেখিত আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাসের সংখ্যায় বেশ
বিভ্রাট ল করা যায়। জিনান সৈয়দের তালিকায় উপন্যাসের সংখ্যা ১৫টি আর আহমদ মাযহারের তালিকায়
১৬টি। দু’জনের তালিকায় একটি কমন ভুলহচ্ছে দুজনই একটি উপন্যাসের ব্যাপারে অসচেতনতা দেখিয়েছেন।
অ-তে অজগর’ উপন্যাসটি ১৯৮২ সালে বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত আর এটিই ২০১০ সালে সূচিপত্র
থেকে নাম পাল্টিয়ে ‘ইছামতির এপার-ওপার’ নামে মুদ্রিত হয়। লেখক প্রকাশক উভয়ই পাঠকের কাছেকিছুটা।
অস্পষ্টতা রেখেছেন এ নাম পাল্টানোর ব্যাপারে। সচেতন পাঠক না হলে এ অস্পষ্টতা থেকেই যাবে। এ অসচেতনতা
আহমদ মাযহারের কাছে কাম্য ছিল না। আহমদ মাযহার ‘প্রেম’ নামে ১৯৯৯ সাল ও ২০০৫ সালে প্রকাশিত
দুটো উপন্যাসের উল্লেখ করেছেন। মূলত : ‘প্রেম’নামে তার কোনো উপন্যাস নেই, এটি ‘পোড়ামাটির কাজ’
ও ‘উৎসব’ নামের দুটো উপন্যাসের যুথ প্রকাশ। অ্যাডর্ন, এর প্রথমও দ্বিতীয় মুদ্রণ করেছে ১৯৯৯ ও ২০০৫ সালে।
তেমনি ভাবে ‘শ্যামলী তোমার মুখ’ ও ‘শ্রাবস্তীর দিবারাত্রি’ যুথ প্রকাশিত সৈয়দে নভেলা। প্রথমে আলাদাভাবে
প্রকাশ ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে পরে যুথভাবে ২০০৮ সালে। ‘উৎসব’ ও ‘ঢাকার আলী বাবা’
উপন্যাসের উল্লেখ নেই তাদের তালিকাদ্বয়ে। যা সূচিপত্র ২০১০ ও অ্যাডর্ন, ২০০৫
সালে প্রকাশ করে। তাছাড়া সৈয়দের ‘রহস্যময়’, দরোজা, গভীর গভীতর অসুখ, এ তিন
উপন্যাসের প্রথম দুটির উল্লেখ নেই। এগুলোর কি নাম সংক্রান্ত জটিলতা আছে? সৈয়দ কি বার
বার পাল্টিয়েছেন নামগুলো? তা আমারও জিজ্ঞাসা। তবে ‘গভীর গভীরতর অসুখ’ নভেলাটি
‘গভীর’ নামে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল তার একুশে বাংলা প্রকাশন থেকে ২০০৭ সালে ‘নির্বাচিত
উপন্যাস’ গ্রন্থে। আশ্চর্য লাগছে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ‘অ-তে অগজর’ উপন্যাসের নামটি ঠিক
থাকলো ২০১০ এসে তা ‘ইছামতির এপার ওপার’ হয়ে গেল পাঠককে সামান্য তথ্য জানানো
ছাড়া। আমার পরিসংখ্যানে আবদুল মান্নান সৈয়দে প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৮টি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ সেই কৈশোর থেকে কতনা পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। ল্যামপোস্ট
পত্রিকা ‘প্রভাতী’ থেকে শুরু করে শেষ পর্যায়ে ‘ মান্নান সৈয়দ শিল্পকেন্দ্র’ কতো বিচিত্র না তার
সম্পাদনা চারিত্র। যার পরিচয় ‘সম্পাদকের কলমে’ পাওয়া যাবে গ্রন্থাকারে। তার বহুমাত্রিক
সৃজনশীল বৈশিষ্ট্য সত্যিই আশ্চর্য্য করে আমাদের।
প্রিয় সম্পাদক!
ছন্দ : আবদুল মান্নান সৈয়দ : সালাউদ্দিন আইয়ুবের লেখা গ্রন্থালোচনা। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ
বাঙলা একাডেমী থেকে ১৯৮৫ সালে। অবসর প্রকাশনী থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০১ সালে।
প্রথম সংস্করণে এটি ছিল ছোট চটি বই। ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজের একটি। দ্বিতীয়
সংস্করণ বহুবর্ধিত।
সালাউদ্দীন আইয়ুবের এ আলোচনাটি পুনর্মুদ্রণ। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে
প্রকাশিত সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা ‘নোঙর’ সপ্তদশ সংখ্যা (সেপ্টেম্বর ২০১০)
সংখ্যায়। তাই বাংলা একাডেমী প্রকাশিত উত্তরাধিকার প্রকাশ পাওয়ায় পুনর্মুদ্রণ তথ্যটি নাদেখে
কিছুটা বিস্মিত হয়েছি।সালাউদ্দীন আইয়ুব আলোচনার শুরুতেই লিখেছেন ‘নামের দিক থেকে
আকাডেমিক শোনালেও,আবদুল মান্নান সৈয়দের ছন্দ (অবসর, ২০১০) একটি সৃজনশীল অনুপ্রাণিতগ্রন্থ।’
এ মন্তব্যের সাথে সর্ববেশে ঐকমত হওয়া যায় না। গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিন্যাসিত এবং পরিশেষ
শিরোনামে সংযোজিত বর্ধিত আলোচনা বটে। কিন্তু প্রথম পর্বই একাডেমিক। প্রথম পর্বের উপ
শিরোনামগুলো উলেখ
করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন এ গ্রন্থের চারিত্র।
পরিচয়
শিল্প ও বিজ্ঞান
অরবৃত্ত
মাত্রাবৃত্ত
স্বরবৃত্ত
গদ্যছন্দ
মিশ্রছন্দ
মূলত : আবদুল মান্নান মানড়বান সৈয়দ তার সমস্ত কৃর্তিতে আপন স্বাতন্ত্র্য মুদ্রিত রাখতেন বলে প্রবন্ধের
উপস্থাপনাও সৃজনশীলতায় উন্মুখ। কিন্তু তা একাডেমিক আলোচনাকে ছাড়িয়ে নয়।
এছাড়া : দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পরিশেষ অংশের সাথে আইয়ুবের মন্তব্য মিলে যায়। যেমন বলেছেন
আইয়ুব: ‘এর মধ্যে পাব ছন্দ বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের বিভিনড়ব মৌলিক চিন্তাভাবনার
একটা সারৎসার’।
হ্যা, এই গ্রন্থ আলোচনায় আমরা চমৎকারভাবে সালাউদ্দিন আইয়ুবকে সাবৎসার উদ্ধারে তৎপর
দেখি। তার অসাধারণ মূল্যায়ন:
‘আমি বাংলাদেশে আর কোনো লেখককে জানি না যার কাছে আর সবই পায়েরদলা মুথাঘাস
কেবল সাহিত্যই অনন্তনীলিমা’।
আত্মবৃত কবি শিরোনামে লিখেছেন সৌভিক রেজা। তার আলোচনাটি বিশদ ভূমিকা নিয়ে এবং
বিশ্বকবিতার পটভূমিতে জর্মনভাবুক টমাস মান ও আইরিশ সমালোচক ইয়েটস এর বিপ্রতীপ
দর্শনকে মুখোমুখি করে তিনি মানড়বানের কবিতা বিশ্লেষণ করেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার প্রাথমিক অন্বিষ্ঠ ছিল এমনি:
‘আমার কবিতার কেন্দ্রিয় চরিত্র সব সময়ই আমি। নৈর্ব্যক্তিক কবিতা বলে কোনো কিছু আমি স্বীকার করি না’
টমাস মান কিংবা ইয়েটস নয়, কবিতার সৈয়দ সে অন্যরকম। গ্রীক পুরানের সত্য দ্রষ্টা অন্ধজ্ঞানী ‘তেইরিসাসে’র
মত নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন সৈয়দ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ এ। সেই সৈয়দকে এর আগে কেউ কি
দেখেছেন? না, তার প্রথম কাব্যসমালোচক কথাশিল্পী শওকত ওসমানের সুরলিয়াজমের দিকেই সবার অঙুলি
চলেছে এতোকাল। অথচ তার অজস্র সাাৎকার এবং স্মৃতিকথায় তিনি বার বার উলেখ করেছেন তিনি ‘পরাবাস্তবাদ’
যা বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বাহিত হয়ে রচিত হয়েছে তা জ্ঞাতই ছিলেন না। পরবর্তীতে সুরালিয়াজমের দিকে
ঝুঁকেছেন গ্রীক পুরানের আরেক চারিত্র্য আত্মমুগ্ধ চারিত্র নার্সিসাসের মত। সৌভিক রেজা এই দিকটি উন্মোচন করেন
চমৎকারভাবে।
বিশ্বসাহিত্যের আত্মমগড়ব সৈয়দের সেই সময়ের তুমুল পাঠক আর ক’জন ছিলো? সাহিত্য
আত্মপ্রাণ এ কবি প্রথম যৌবনেই বিশ্বসাহিত্যে ছেকে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন অনন্য স্বাতন্ত্রে।
তাকে তাই তার কুটাভাষ দিয়েই চিহ্নিত করা যায়। মান্নান সৈয়দ মাইকেল মধুসূদনের মতই
প্রকরণে মাইকেল বিষয়ে মধুসূদন দিলেন।
‘জটিল সৌন্দর্যের কবি’ শিরোনামে লিখেছেন পিয়াস মজিদ। মূলত: কবিতা কেন্দ্রিক
আলোচনা। আলোচনা নয় রেখাচিত্র, ধুসর রেখাচিত্রও নয় কোটেশ আক্রান্ত ‘অনুভাবনা’ বলা
যাবে। আর কোটেশন গুলোও যৌক্তিক বিন্যাসে পৌঁছায়নি। যেমন মান্নান সৈয়দের কবিতা
মূল্যায়নে পঞ্চাশে কবি শহীদ কাদরীর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ বইটি গোটা বাংলা কবিতার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’
কিন্তু কেন?
এক. গতানুগতিক ছন্দহীনতা
দুই. গীতিময়তা
প্রসঙ্গ দুটোই কি পরষ্পর স্ববিরোধী নয়?
আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার অন্তরাগত প্রেরণায় যে কজন নায়িকা কূল ভাসিয়েছেন তাদের
নিয়েও কেউ আলোচনা করলেন না। পিয়াস মজিদতো নয়-ই। তিনি সোনালী চট্টোপাধ্যায়তেই
লেপটে রইলেন। অথচ কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘মীর বন্দোপাধ্যায়’ কে নিয়ে কতো কিছুই না
লিখলেন উপন্যাসে, কবিতায়। কাব্যগ্রন্থের নামই তো রাখলেন মীরা বন্দোপাধ্যায়
এছাড়া তার কবিতা ও স্মৃতিকথা একে একে প্রেরণা দাত্রি ছিলেন স্বপনা সুলতানা, ডলি, সোনালী
চট্টোপাধ্যয়, রানুসহ অনেকেই।
এই কবির ভেতর মানুষটি উন্মোচন কবিতার স্বার্থেই প্রয়োজন ।যেমনি এখনও শেক্সপিয়রের
কবিতাও নাটকের নেপথ্য চারিত্র্যগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে।
পিয়াস মজিদের বালখিল্যময় উক্তি তার (পিয়াস মাজিদের) অন্তসারশূণ্য জীবনদৃষ্টিকে উন্মোচন
করলে এ মন্তব্যে-‘ মাঝখানে তিনি ছিটকে পড়েন ‘আমার সনেট’ আর ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ এর
অমানড়বানীয় গুহায়’। এ মন্তব্যে অ মান্নানীয় বলতে কী বুঝিয়েছেন তাও স্পষ্ট করলেন না।
অথচ এদুটো গ্রন্থ আবদুল মান্নান সৈয়দকে দিয়েছে নবতর ভিন্ন মাত্রা।
এক. ‘আমার সনেট’ বাংলা সনেটের ধারায় নবতর সংযোজন। এ গ্রন্থে সৈয়দ সনেটকে মুক্তি
দিয়েছেন বিধিবদ্ধ শেক্সপীরীয় বিন্যাসের শৃংখল থেকে। প্রথম মুক্তি দিয়ে ছিল কবি জীবনানন্দ
দাশ ২২ মাত্রার সনেট লিখে। এরপর আর কেউ তা অতিক্রম করতে চাননি। আবদুল মান্নান
সৈয়দ কখনো মাত্রায়, কখনো পর্বে, কখনো পংক্তির মুক্ত, যুক্ত কিংবা অতি বিন্যাসে।
দুই. ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ সৈয়দের একটি আধ্যাত্মিক প্রকাশ। যারা আধ্যাত্মিকতাকে ধার্মীকতার
সাথে গুলিয়ে ফেলেন তাদের পে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য অবশ্যই হবে। কিন্তু জীবন সম্পর্কে
যাদের সৃষ্টি সামগ্রীকতা কে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে। জীবনকে যারা যাপন করে করে- দর্শন ঠিক করেন।
তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন জীবনের সেই রাহস্যিক ভূগোল কী? দেহতান্তিক চৈতন্যবাদিদের
পে তা উপলব্ধি সম্ভব নয়। আমাদের কথা: আবদুল মান্নান সৈয়দের আত্মকথা
তারও উৎস উল্লেখ হয়নি। যা তার একটি ঔপন্যাসের কথামুখ হয়ে আছে। তিনটি কবিতা
গ্রন্থিত হয়েছে এসংখ্যায় উদ্বাস্ত কবি, ফিনিক্স, মাছ এতিনটি কবিতারও উৎস উল্লেখনেই।
আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি আলোচনা গ্রন্থিত হয়েছে। তার ব্যতিক্রমী পত্রপ্রবন্ধের এটি একটি।
শোকগাথা: রনেশ দাশ গুপ্তের স্মরণে বিশিষ্ট মাকর্সিস্ট সমালোচক রণেশ দাশ গুপ্তকে নিয়ে তার
আরও একটি পত্র প্রবন্ধ আছে ‘বইয়ের জগৎ’ চতুর্থ সংখ্যায় ‘অশোক ফুলের লোপা নামে’।
অসাধারণ এ দুটো পত্র প্রবন্ধ। বিশ্বসাহিত্যে পত্রপ্রবন্ধ চর্চা হয়েছে বলে আমার তথ্যে নেই। বাংলা
সাহিত্যে ছোটগল্প ও উপন্যাস আছে রবীন্দ্রনাথ ও শাহেদ আলীর কিন্তু প্রবন্ধ’না। প্রথম পত্র প্রবন্ধ
চর্চা শুরু করেন আবদুল মান্নান সৈয়দই সম্ভবত ১৯৯০ সালে। একবিংশ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে
প্রকাশিত সংখ্যায় খন্দকার আশরাফ হোসেনের সৈয়দের কবিতা আলোচনার প্রতিক্রিয়া
জানাতেই। এপর্যন্ত প্রায় ২০টির মত এ প্রবন্ধ আমরা পাই সৈয়দের হাতে। এক একটি চারিত্র ও
বৈশিষ্ট্য চমকপ্রদ এবং চৈত্রিময়। আগামীর পাঠকের জন্য এটি উল্লেখ হয়ে থাকলো।
এসব প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ আলো ফেলেছেন বিচিত্র বিস্ময়ে। সাহিত্যের অন্তরলোক থেকে
শুরু করে গবেষণাও চালিয়ে গেছেন তিনি এ প্রকারণে।
জিনান সৈয়দ লিখেছেন ‘আমার আব্বু’ শিরোনামে। ব্যক্তি সৈয়দ এর একটি সরলরূপ তার
লেখার মধ্যে উঠে এসেছে। আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবন ও রচনাপঞ্জি উত্তরাধীকার এ সংখ্যার
প্রশংসারযোগ্য সংযোজন। জিনান সৈয়দের করা এ তথ্যপঞ্জীতে কিছুটা তথ্য বিভ্রাট থাকলেও
আগামীর মান্নান সৈয়দ গবেষকদের জন্য এটি অসাধারণ উৎস হিসেবে কাজ করবে। তথ্য
বিভ্রাট হলো: ‘অ-তে অজগর’ ও ‘ইচ্ছামতির এপারওপর’ উপন্যাসকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা
করা। মূলত : এটি উপন্যাসেরই নাম পাল্টানো রূপ। যা আমি আগেই উলেখ
করেছি।
এ সংখ্যায় অপূর্ণ রূপ যেটি সৈয়দের কোন গল্পরই সংকলিত রূপ পাঠক পায়নি। চাইলে একটি
নাটিকাও সম্পাদনা পর্ষদ সংযোগ করতে পারতেন। গল্প, নাটক ও উপন্যাসের আলোচনা তো
নেই-ই।
ব্যক্তি আবদুল মান্নান সৈয়দের অনন্য একটি রূপ আমরা পেয়েছিলাম শেষ জীবনে এসে।
অভিনেতা হিসেবে। তারিনের বাবা হিসেবে সে দুর্দান্ত অভিনয় যারা দেখেছেন সৈয়দকে মূল্যায়ন
সত্যিই ভিনড়বভাবে করবেন।
তাৎণিক স্মরণসংখ্যা হিসেবে উত্তরাধিকারের এ সংখ্যা প্রশংসার কিন্তু জাতীয় প্রতিষ্ঠান
হিসেবে সৈয়দ সংখ্যাটি কিন্তু আরও যত্নের দাবী রাখে। অন্তত: একটি সামগ্রিক সৈয়দের রূপ
পাঠকের চাহিদা ছিল। তা আমরা পাইনি।
জনাব
সম্পাদক
দীর্ঘ এ চিঠির একটি নেপথ্য উদ্দেশ্য ছিলো। বাংলা সাহিত্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ পত্র প্রবন্ধের
যে চমৎকার উদাহরণ রেখে গেছেন সেই আঙ্গিক চর্চায় তাকে শ্রদ্ধা জানানো। তাই এ চিঠির দীর্ঘ
পরিসরে সামগ্রীক সৈয়দকে তুলে আনতে চেষ্টা ছিলো। জানিনা বাংলা একাডেমীর বিভিন্ন স্মরণ
সংখ্যার নির্ভরযোগ্য সংকলন প্রণয়নের জন্য যে আবদুল মান্নান সৈয়দ -অনন্য নির্ভরযোগ্য
সম্পাদক ছিলেন, তাঁর সামগ্রিক রূপ উন্মোচন বাংলা একাডেমীর করবে কিনা? কোনো
স্মর্তব্য উদ্যোগ নেবে কিনা? এ বুনো জোছনায় তাই এ গান গাওয়া এবং সেই আলো আকাঙ্খী আশা
নিয়েই এ পত্রের পত্রপাঠ ঘুচানো। উত্তরাধিকার তার উত্তরাধিকার বয়ে চলুক। শুভ কামনা।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ
২৩.০১.২০১১

One Reply to “”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান